ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন এক সাধারণ চিত্র। এটি এক সময় শুধু পাড়ার অলিগলিতে দেখা যেত, এখন তা শহরের মূল সড়কেও চালানো হচ্ছে। এই বাহনের উপস্থিতি নিয়ে জনমনে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ একে স্বস্তিদায়ক ও আধুনিক নগরজীবনের অংশ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ একে নগর শৃঙ্খলার জন্য হুমকি মনে করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাহন এখন একটি বাস্তবতা এবং এর কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা উভয়কেই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। এ লেখায় আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশার উপযোগিতা, এর কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো, সম্ভাব্য সমাধানের পথ এবং যদি এটি পুরোপুরি বন্ধ করতে হয় তবে সে প্রক্রিয়া নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রথমে দেখা যাক ব্যাটারিচালিত রিকশা কেন এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ স্বল্প দূরত্বে চলাচল করে। এই চলাচলের জন্য নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বাহনের অভাব দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। সাধারণ রিকশা চালাতে শারীরিক শ্রম বেশি লাগে এবং একে একা চালিয়ে আয় করা চালকের জন্য কষ্টকর। অথচ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে শরীরের চাপ কম পড়ে, ফলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি বা শারীরিকভাবে দুর্বল মানুষও এটি চালাতে পারেন। ব্যাটারির সাহায্যে গতি ও নিয়ন্ত্রণ সহজ হওয়ায় এতে কম সময়ে বেশি যাত্রী পরিবহন সম্ভব হয়, ফলে চালকদের আয়ের সম্ভাবনাও বাড়ে। এসব কারণেই এটি চালকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
যাত্রীদের দিক থেকেও এর কিছু সুবিধা রয়েছে। তবে সুবিধার পেছনে রয়েছে কিছু গুরুতর সমস্যা, যা ব্যাটারিচালিত রিকশাকে এখন নগর পরিবহনের জন্য একটি জটিল চ্যালেঞ্জে পরিণত করেছে। প্রধানত এই বাহনটি সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে উঠেছে। এর কোনো বৈধ নীতিমালা ছিল না, কোনো রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া ছিল না, চালকদের কোনো লাইসেন্স দরকার হয়নি। ফলে যার ইচ্ছা সে-ই এই বাহন চালাতে শুরু করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের হাতেও এই বাহনের স্টিয়ারিং চলে গেছে। তারা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালায়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। শুধু তাই নয়, এই বাহনগুলোর গঠনশৈলীতেও রয়েছে নানা ত্রুটি। এগুলোর ব্রেকিং সিস্টেম ঠিকঠাক না হওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, ব্যাটারির মান খারাপ হওয়া, এমনকি চার্জ দিতে গিয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটাও আজকাল নতুন নয়।
এর পর আসে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন। রিকশা মূলত ধীরগতির যান, কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি সাধারণ রিকশার চেয়ে বেশি হওয়ায় এটি এক ধরনের ‘মিড-স্পিড ভেহিকল’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে এটি দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে সংঘাতে পড়ে এবং ধীরগতির যানবাহনের পথেও বিঘœ সৃষ্টি করে। সিগন্যাল অমান্য করে চলা, উল্টো পথে চলা, রাস্তায় যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো- এসব কারণে এটি যানজটের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, নগর কর্তৃপক্ষ বা ট্রাফিক বিভাগও অনেক সময় জানে না ঠিক কতগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশা শহরে চলছে। অনুমানভিত্তিক হিসাব বলছে, ঢাকায় প্রায় তিন লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে, যার বেশির ভাগই অবৈধভাবে চলছে। কোনো কাগজপত্র ছাড়াই এরা প্রতিদিন নগরীর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ বলছেন, এই বাহনটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যদি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা হলে প্রথমেই প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশনা। এই নির্দেশনায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এটা শুধু নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। চালকদের পুনর্বাসনের ব্যাপারেও ভাবতে হবে। বহু মানুষ এই বাহনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে শুধু নিষেধাজ্ঞা দিলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এজন্য তাদের বিভিন্ন দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য পেশায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। যেমন কেউ হালকা যানবাহনের চালক হতে পারেন, কেউ খুচরা ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন কিংবা সরকারের অন্যান্য কর্মসূচির আওতায় ভিন্নমুখী পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন।
অন্যদিকে যদি সিদ্ধান্ত হয় যে, ব্যাটারিচালিত রিকশা পুরোপুরি বন্ধ না করে নিয়ন্ত্রণে আনা হবে, তা হলে তার জন্য প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ ও যুগোপযোগী নীতিমালা। প্রথমত, এই বাহনগুলোর বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে। প্রত্যেকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার আলাদা একটি নম্বর থাকতে হবে এবং সেই নম্বর কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, চালকদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। লাইসেন্স পেতে হলে চালকদের নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যেখানে ট্রাফিক আইন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, যাত্রী নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তৃতীয়ত, শহরের কোন কোন এলাকায় এই বাহন চলতে পারবে তা নির্ধারণ করতে হবে। প্রধান সড়কে এটি চালানো যাবে না। শুধু আবাসিক এলাকা, স্কুল-অফিসকেন্দ্রিক গলিপথ, বাজারের পার্শ্ববর্তী সড়ক- এমন কিছু জায়গায় সীমিতভাবে চলাচলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণেও প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। জিপিএস ও স্পিড গভার্নর সংযুক্ত করে নির্ধারিত গতির বেশি উঠলেই রিকশা স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে, এমন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। শহরে কোথায় কোথায় এই বাহন চালানো যাবে তা নির্ধারণ করে সেখানে ডিজিটাল সাইনবোর্ড বসানো যেতে পারে, যাতে চালক ও যাত্রীরা দুপক্ষই জানে নিয়ম কী। এর পাশাপাশি একটি নিয়মিত তদারকি দল গঠন করতে হবে, যারা সপ্তাহে অন্তত একবার রিকশাগুলো যাচাই করবে এবং অবৈধ বা নিয়মভঙ্গকারী বাহনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো চার্জিং স্টেশন। এখন যেভাবে বাসার বারান্দা বা দোকানের সামনে অবৈধ চার্জিং পয়েন্ট গড়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে বিদ্যুৎ চুরি যেমন হচ্ছে, তেমনি অগ্নিকা-ের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই সরকারিভাবে নির্ধারিত চার্জিং স্টেশন তৈরি করতে হবে, যেখানে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হবে। এই চার্জিং পয়েন্টগুলোতে মানসম্পন্ন ব্যাটারিও বিক্রয় বা ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যাতে নিম্নমানের ব্যাটারির কারণে দুর্ঘটনা না ঘটে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার নাগরিক জীবনে একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিকে অস্বীকার করে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু এটিকে যেভাবে এখন চলছে সেভাবে চলতে দিলে তা নগরজীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। অতএব আমাদের দরকার একটি সুসংহত পরিকল্পনা, যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশার উপযোগিতা এবং এর সীমাবদ্ধতা দুটোই বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ, আইনি কাঠামো এবং সামাজিক সচেতনতাই পারে এই বাহনটিকে শহরের জন্য আশীর্বাদে রূপ দিতে। অন্যথায় এটি দুর্যোগে পরিণত হতে সময় নেবে না। কাজেই এখনই সময়- আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কীভাবে এই বাহনকে শহরের বন্ধু করে তুলব, নাকি প্রয়োজন হলে কোন পদ্ধতিতে শহর থেকে বিদায় জানাব।